প্রথমে পদব্রজ। এরপর প্রাণীচালিত যানবাহন। যোগাযোগে প্রাচীন পৃথিবীতে এর বাইরে কিছু ভাবারই সুযোগ ছিলো না। ৫ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় যখন চাকা আবিষ্কৃত হয়, তখন থেকেই যানবাহনের ক্রমাগত পরিবর্তন চলতে থাকে। তবে ১৫০০ সালের দিকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ‘স্বচালিত গাড়ি’ এর মতো ধারণা দিয়ে যেন এক নতুন দুয়ার খুলে দিলেন। তারপর তো ইতিহাস। দ্য রাইডার অবলম্বনে জানানো হচ্ছে তা ।
গল্পের শুরুতে আমরা জেনে নেই ‘অটোমোবাইল’ শব্দটির উৎপত্তি। গ্রিক শব্দ ‘অটোস’(স্ব) ও ল্যাটিন শব্দ ‘মোবিলস’ (চলন্ত) এই দুইটি শব্দ থেকেই আজ অটোমোবাইল শব্দের সৃষ্টি। যার পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় স্বচলন্ত অর্থাৎ নিজে নিজে চলতে পারে। এবার একটু পিছনে ফেরা যাক। জানা যায়, ১৬৭৮ সালে ফার্দিনান্দ ভারবিয়েস্ট, বেলজিয়ান জেসুইট ধর্মপ্রচারক, আধুনিক টারবাইনের একটি নীতিগত পরামর্শের ভিত্তিতে বাষ্প ক্যারিয়ার তৈরি করেছিলেন। যেটি একটি ৬৫ সেমি দীর্ঘ এক স্কেল মডেল, যা কোনো ড্রাইভার বা যাত্রী বহন করতে অক্ষম ছিল।
তবে ১৭৭৬ সালে স্কটিশ বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটের ‘বাস্প ইঞ্জিন’ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে অটোমোবাইল শিল্প নতুন যুগের পদার্পণ শুরু করে। কিন্তু এত কিছুর পরও একজনকে সত্যিকার অর্থে অটোমোবাইলের সৃষ্টিকর্তা বলা হয়। নিকোলাস-জোসেফ কাগনাট। কাগনাটের তৈরি মডেল গাড়িটি চারজন মানুষ বহন করে প্রতি মিনিটে ২.২৫ মাইল (৩.৬ কিলোমিটার) প্রতি ঘন্টায় ২০ মিনিটের জন্য চালিত ছিল।
তার বাষ্পচালিত গাড়ি ১৭৯০ সালের দিকে ফ্রান্সের আমিয়েন্সে প্রথম আবির্ভূত হয় এবং ১৮০০ সালের দিকে প্যারিসের রাস্তায় বাষ্পচালিত বাস চলাচল শুরু করে।
এইদিকে ইভান্স নামে প্রথম আমেরিকান, যিনি একটি স্বচালিত গাড়ি জন্য পেটেন্ট করেন, সেখানে তিনি একটি বাষ্প ওয়াগন এবং একটি সমতলদেশী নৌকা দুইটিকে সমন্বয় তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন।
ব্রিটেনের সবচেয়ে সফল সময় যদি বলা হয়, তা হলো ১৮৩০ সালকে। বাস্পচালিত বিভিন্ন কোচের জন্য এই সময়টাকে সফল সময় বলা হয়। লন্ডন থেকে ক্যামব্রিজসহ আরো বেশ কিছু রুট তখন উচ্চবিলাসী ছিল। অন্যদিকে ধীরে ধীরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি এবং ডেনমার্কে হালকা বাষ্পচালিত গাড়ি তৈরি করা শুরু করে। আমেরিকানদের বাষ্পচালিত অটোমোবাইলের দৃঢ়তা স্ট্যানলি ভাইয়ের যুগের থেকেও শক্তিশালী ছিল যার মধ্যে একটি, হলো স্টিমার। ১৯০৬ সালে প্রতি ঘন্টায় ১২৭.৬৬ মাইল (২০৫.৪৫ কিলোমিটার) গতিতে বিশ্ব রেকর্ড করেছিল।
রেলগাড়ি তৈরিতে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল হলে আমেরিকানদের নিজস্ব অটোমোবাইল শিল্প গড়ে ওঠে ( ১৯০০ সালে প্রায় ১০০০টি শিল্প কারখানা নির্মিত হয়েছিল)। আনুমানিক ২০০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬০০টি বাষ্প গাড়ি ছিল, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই চলমান।
তবে এই বাষ্পচালিত অটোমোবাইলের চেয়ে অটোমোবাইলের বাণিজ্যিক ইতিহাস পেট্রোল চালিত ইঞ্জিনের আবিষ্কারের সাথে সাথেই শুরু হয়েছিল। এজন্য জার্মানির কার্ল বেনজ এবং গটলিয়েব ডেমলারকে পেট্রোল-ইঞ্জিন অটোমোবাইলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী হিসাবে সম্মান করা হয়। ১৮৮৫ সালে বেনজ প্রথম গাড়ি চালান, ১৮৮৬ সালে ডেমলার। আজকের দিন আমরা যেক’টা ভালো ভালো গাড়ির কোম্পানির নাম জানি, তার মধ্যে ‘মার্সিডিজ বেনজ’ হলো অন্যতম। এই মার্সিডিজ বেনজ গাড়ি কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কার্ল বেনজ ও গটলিয়েব ডেমলার।
গাড়ির ইঞ্জিন মূলত দুই স্ট্রোক ও চার স্ট্রোকের হয়ে থাকে। স্ট্রোক হলো গাড়ির ইঞ্জিনের মধ্যকার কাজের ধাপ। আমরা রাস্তাঘাটে যেসব গাড়ি দেখি তার মধ্যে মোটরসাইকেল ছাড়া বাকি সব গাড়িই চার স্ট্রোক ইঞ্জিনের। তবে সেগুলো হয় গ্যাস, ডিজেল কিংবা পেট্রোলচালিত। প্রতিভাবান ফরাসি প্রকৌশলী আলফনস বউ দ্য রোকাস ১৮২৬ সালে সর্বপ্রথম চার স্ট্রোক নীতি আবিষ্কার করেছিলেন।
তার এই চার স্ট্রোক চক্র নীতি অনেকে ‘অটো চক্র’ নামেও জানেন। জার্মান নিকোলাস আগস্ট অটো ১৮৭৬ সালে সেই নীতির উপর একটি ইঞ্জিন ডিজাইন করেন। পেট্রোলচালিত ইঞ্জিনগুলোই অটো চক্র নীতি মেনে কাজ করে।
১৮৯০ সাল নাগাদ দুই ফরাসি প্যানহার্ড ও লেভ্যাসর, ডেমলার ইঞ্জিন দ্বারা চালিত অটোমোবাইলগুলোর বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং এই দুইজনই প্রথমবারের মতো ইঞ্জিন গাড়ির সামনে স্থাপন করে গাড়ি তৈরি শুরু করেন। মজার ব্যাপার হলো, গাড়ির ‘বোনাটের’ চিন্তাটাও এই দুই ভদ্রলোকের। এইদিকে ডেমলারের অটোমোবাইলে কাজের নেশা যেন বাড়তে থাকে। তিনি ইঞ্জিনে নতুন বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেন। সিলিন্ডার গ্যাস বিস্ফোরিত করার জন্য তিনি প্রথম ভি-টুইন ইঞ্জিনটি একটি জ্বলন্ত প্ল্যাটিনাম টিউব দিয়ে তৈরি করেছিলেন। যেটি স্পার্কিং প্লাগের সবচেয়ে প্রাচীন রূপ।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় অটোমোবাইল শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন শুরু হয়। ১৯২৬ সালে ডেমলার এবং বেনজ একত্রিত হয়ে তাদের পণ্যগুলো ‘মার্সেডিজ-বেঞ্জ’ নামেই বিক্রি করা শুরু করেন। পাশাপাশি আরো কিছু কোম্পানিও বাণিজ্যিকভাবে গাড়ি তৈরি শুরু করে যেমন ফোর্ড, জেনারেল মোটরস, রোলস-রয়েলস লিমিটেড, ক্যাডিল্যাক, মেইব্যাক, ব্যান্টলেয় মোটরস লিমিটেড, বুগাট্টি ইত্যাদি।
এই শিল্পের শুরুর দিকে এটিকে ব্যক্তিগত বিলাসবহুল বস্তু হিসেবে ব্যবহারের সংস্কৃতিটা চলে আসলেও, ফোর্ড অটোমোবাইল সর্বপ্রথম এটিকে বিলাসিতা বস্তুর চেয়ে জনসাধারণের ক্রয়সাধ্য এবং প্রয়োজনীয় একটি দ্রব্যে রুপান্তরের ব্যাপারে জোর দেয় এবং সেভাবে গাড়ির বাণিজ্যিক প্রস্তুতি বাড়াতে থাকে। আর হেনরি ফোর্ডই ফোর্ড অটোমোবাইলসের স্বপ্নদ্রষ্টা।